শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৯ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ভূ-রাজনীতির খেলার মাঠ বাংলাদেশ

ভূ-রাজনীতির খেলার মাঠ বাংলাদেশ

স্বদেশ ডেস্ক:

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (ইন্দো-প্যাসিফিক) প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এই খেলার এক দিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত; অন্য দিকে চীন ও রাশিয়া। কিন্তু ভূ-রাজনীতির এ খেলায় খেলতে যাওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। তাই জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশকে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। আর একটি বৈধ ও শক্তিশালী সরকারের পক্ষেই কেবল এই ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নেয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে কিছু করানোটা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন অভিজ্ঞ কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য না থাকলে একটা বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ভূ-রাজনীতির এই খেলায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্যও সচেষ্ট রয়েছে বিশ্বের দেশগুলো। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দিল্লি ও ওয়াশিংটনে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। দিল্লি আবার নিজ স্বার্থে বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনকে প্রভাবিত করা চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তারা সরাসরি আলোচনাও করছে। তবে নির্বাচনকে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এই বিতর্ক থেকে আপাতদৃষ্টিতে দূরে রয়েছে চীন ও রাশিয়া।
আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ হলো বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা। এই নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা অবৈধ কাজে সহযোগীদের ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য। গত ২৪ মে ঘোষণার দিন থেকে কার্যকর হওয়া এই ভিসানীতির আওতায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও থাকবেন।

তবে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতিতে নাখোশ ভারত। এমনকি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মন্তব্যও ভারতের পছন্দ হচ্ছে না। সম্প্রতি ওয়াশিংটনকে দেয়া এক কূটনৈতিক বার্তায় দিল্লি জানিয়েছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে তা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র – কারো জন্যই সুখকর হবে না।
এ সব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ভারতে উপ হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক পেশাদার কূটনীতিক হুমায়ুন কবির গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার দু’টি স্তর রয়েছে।

প্রথমটি হলো অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যদি আমরা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে এই প্রতিযোগিতাকে মোকাবেলা করতে পারব। আর দ্বিতীয়টি হল ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাথে চীনের প্রতিযোগিতা রয়েছে। এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা চাই বা না চাই, এই প্রতিযোগিতা চলবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নেই। এই পরিস্থিতিতে আমরা যদি একটি বৈধ ও শক্তিশালী সরকার গঠন করতে পারি, তাহলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের ভূমিকাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের একটা জোরালো অবস্থান থাকবে। তিনি বলেন, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। তাই এখানে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে কোনো না কোনোভাবে আমাদের একটা ভারসাম্য বজায় রাখতেই হবে। একটি বৈধ ও শক্তিশালী সরকারের পক্ষেই কেবল এই অবস্থান নেয়া সম্ভব। কেননা সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে কিছু করানোটা কঠিন হয়ে পড়বে।

বর্তমানে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী হুমায়ুন কবির বলেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বৈধ সরকার, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনকাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজন। এই শর্তগুলো পূরণ হলেই কেবল আমরা নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারব। মনে রাখতে হবে, এটা (প্রভাব বিস্তারে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা) খুবই শক্তিশালী ঝড়। আমরা চাই বা না চাই এটা আমাদের ওপর আঘাত হানবে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের সরকার যদি দুর্বল হয়, তবে (পরিস্থিতির সাথে) আমাদের গুরুতরভাবে সমঝোতা করতে হবে। আর শক্তিশালী সরকারের জন্য সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ইস্যুগুলো এতটাই স্পর্শকাতর যে, দেশের স্বার্থ রক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য না থাকলে একটা বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ার আশঙ্কা থাকে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য না থাকলে একেক রাজনৈতিক দল একক রাষ্ট্রকে সমর্থন করবে। এটা আমাদের সবার জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কেননা এর সুযোগ নিয়ে ‘বানর পিঠা ভাগ করে খেয়ে ফেলবে’।

ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে বিশ্বব্যাপী ঠাণ্ডালড়াই চলছে মন্তব্য করে হুমায়ুন কবির বলেন, প্রতিযোগিতার এই ধারাটা তীব্র গতিসম্পন্ন। এটাকে মোকাবেলা করা কেবল বাংলাদেশ না, ভারতের মতো দেশের জন্যও কঠিন। তাই সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে আমাদের বিপদে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক খেলায় খেলতে যাওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। এই খেলার এক দিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এবং অন্য দিকে রাশিয়া ও চীন। এই বড় খেলাতে অংশ না নেয়াই আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তা না হলে আমাদের তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব আনাম খানের মতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন অবস্থা নিয়ে ভারত স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট চিন্তিত। এ কারণেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত তার অবস্থানটা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পরিষ্কার করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে তৃতীয় পক্ষকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সাথে সরাসরি আলোচনা করছে, এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যায় সার্বিক পরিস্থিতিতে খুব একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, কিছুটা হলেও এর একটা প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পড়বে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877